সুনামগঞ্জসহ ১২ জেলায় আজ থেকে বিধান কার্যকর হচ্ছে
৯ ধরনের মামলার আগে মধ্যস্থতা বাধ্যতামূলক
- আপলোড সময় : ১৮-০৯-২০২৫ ০৯:১৬:১২ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১৮-০৯-২০২৫ ০৯:১৬:১২ পূর্বাহ্ন

সুনামকণ্ঠ ডেস্ক ::
৯টি (পাঁচটি দেওয়ানি ও চারটি ফৌজদারি) আইনের বিরোধ প্রচলিত আদালতে মামলা দায়েরের আগেই মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে জারি করা বিধান আজ বৃহস্পতিবার থেকে সুনামগঞ্জসহ ১২টি জেলায় কার্যকর হচ্ছে। এই জেলাগুলো হচ্ছে- ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রংপুর, সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাঙামাটি, সিলেট, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ। এই বিধান কার্যকর করার জন্য গত মঙ্গলবার আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া এই বিধান প্রয়োগের জন্য বিধি তৈরি করেছে সরকার। সেই বিধিও প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হয়েছে।
বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সিলেট নগরের একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। পাইলট প্রকল্প হিসেবে এই কার্যক্রম শুরু হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বিচার ব্যবস্থায় নব অধ্যায়ের সূচনা হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনুষ্ঠানে আসিফ নজরুল বলেন, আমরা সিভিল ও ক্রিমিনাল আদালত পৃথক করেছি, যাতে মামলার নিষ্পত্তি দ্রুতগামী হয়। এটা এর আগে কোনোদিন কেউ করেনি। আগে বিচারিক পদ সৃজনের ক্ষমতা পলিটিক্যাল মন্ত্রীদের হাতে ছিল, এটা আমরা চিফ জাস্টিস অফিসারের হাতে দিয়ে গেছি। সেই ফাইল আমরা নিজ হাতে গিয়ে সাইন করে নিয়ে এসেছি। পিয়নের মতো করে নিজে ফাইল নিয়ে গিয়ে সাইন করিয়েছি। আমরা যা যা করেছি, কোনোদিনই বাংলাদেশে এর আগে হয়নি।
নতুন বিধান কার্যকরের সুফল সম্পর্কে উপদেষ্টা বলেন, মামলাপূর্ব মধ্যস্থতার বাধ্যতামূলক বিধানের ফলে মানুষের অধিকার সুরক্ষার পথ আরও সুগম হবে। একদিকে যেমন মামলা নিষ্পত্তির সময় কমবে, তেমনি খরচও বাঁচবে। মামলার জট হ্রাস পেয়ে জনগনের হয়রানি দূর হবে। এ পরিবর্তনের ফলে জনগণ দ্রুত আইনি প্রতিকার পাবে, এতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। তিনি আরো বলেন, লিগ্যাল এইডের মামলাপূর্ব মধ্যস্থতায় বেশিরভাগ বিবাদীপক্ষই সন্তুষ্ট হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমে দুই পক্ষই জয় লাভ করে। একারণেই এটিকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
এর আগে গত ১ জুলাই ‘আইনগত সহায়তা প্রদান (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করে সরকার লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে ৯টি আইনের বিরোধ মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে বিধান জারি করে। এই বিধান কার্যকর করার ফলে, মামলা দায়েরের আগে এসব আইনের বিরোধ লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মধ্যস্থতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হলে বিরোধের কোনো পক্ষ প্রয়োজনে উপযুক্ত আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে এসব আইনের বিরোধ নিষ্পত্তির চেষ্টা না করে কেউই সরাসরি মামলা দায়ের করতে পারবে না।
যেসব আইনের বিরোধ মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে পারিবারিক আদালত আইন, ২০২৩-এর ধারা ৫-তে উল্লেখিত বিষয়; বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন, ১৯৯১-তে উল্লেখিত বিরোধ; সহকারী জজ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত কটন সম্পর্কিত বিরোধ; স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেনান্সি অ্যাক্ট-১৯৫০-এর সেকশন ৯৬-তে উল্লেখিত অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ; নন-এগ্রিকালচার টেনান্সি অ্যাক্ট, ১৯৪৯-এর সেকশন ২৪-এ উল্লিখিত অগ্রক্রয় সম্পর্কিত বিরোধ: পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩-এর ধারা ৮ অনুসারে পিতা-মাতার ভরণপোষণ সম্পর্কিত বিরোধ; নিগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১-এর সেকশন ১৩৮-এ বর্ণিত চেক ডিজঅনার সম্পর্কিত অভিযোগ (অনধিক ৫ লাখ টাকা মূল্যমান চেকের ক্ষেত্রে); যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮-এর ধারা ৩ ও ৪ তে বর্ণিত যৌতুক সম্পর্কিত অভিযোগ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ধারা ১১(গ)-তে বর্ণিত যৌতুকের জন্য নির্যাতন স¤পর্কিত অভিযোগ।
জানা যায়, ২০০০ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান আইন প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের ২১ক ধারা অনুসারে সারা দেশে লিগ্যাল এইড অফিসার বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নি®পত্তি করেন এবং আইনি সেবাপ্রত্যাশীদের আইনি পরামর্শ প্রদান করেন। ২০০৯ সাল থেকে সরকারি খরচে সারা দেশে অসহায় বিচারপ্রার্থীদের জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থার মাধ্যমে আইনি সহায়তা প্রদান কার্যক্রম চালু হয়েছে। আইনি সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিটি জেলায় বর্তমানে একজন করে লিগ্যাল এইড অফিসার রয়েছেন। লিগ্যাল এইড অফিসার একজন বিচারক এবং লিগ্যাল এইড অফিসারের কর্মকে এরই মধ্যে গেজেট দ্বারা বিচারিক কর্ম হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আইনের অধীনে থেকে লিগ্যাল এইড অফিসার ‘মধ্যস্থতা কার্যক্রম’ পরিচালনা করেন এবং আইনি প্রক্রিয়ায় দুই পক্ষের সম্মতি ও সমঝোতায় মধ্যস্থতা চুক্তি স¤পাদন করে থাকেন। এ প্রক্রিয়ায় বিরোধ নিষ্পত্তিতে সুফলও মিলছে। অর্থ ও সময় দুটিই সাশ্রয় হচ্ছে।
২০০৯ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত এই সংস্থায় ১১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৫ জন অসচ্ছল বিচারপ্রার্থী বিনামূল্যে আইনি সেবা নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস, দেশের ৬৪ জেলা লিগ্যাল এইড অফিস, ঢাকা ও চট্টগ্রাম শ্রমিক আইনগত সহায়তা সেল, সরকারি আইনি সহায়তায় জাতীয় হেল্পলাইন কলসেন্টারে (টোল ফ্রি - ‘১৬৪৩০’) মাধ্যমে এ সেবা দেওয়া হয়। আর এ সময়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৫২ কোটি ৫১ লাখ ৬১ হাজার ৮১ টাকা আদায় করে বিচারপ্রার্থীদের দিয়েছে জেলা লিগ্যাল অফিসগুলো। শ্রমিকের পাওনা, ভরণপোষণ, খোরপোশসহ নানা খাতে এই টাকা আদায় করে বিচারপ্রার্থীদের দেন লিগ্যাল এইড কর্মকর্তারা। বর্তমানে লিগ্যাল এইডের মাধ্যমে যে পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে, তা তিন গুণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার আইন সংশোধন করে ৯টি আইনের বিরোধ প্রচলিত আদালতে মামলা দায়েরের আগেই মধ্যস্থতার মাধ্যমে নিষ্পত্তির উদ্যোগ গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে বিধান জারি করে। মধ্যস্থতার মাধ্যমে কোনো মামলা নি®পত্তি হলে বাদী-বিবাদী পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি হবে। সেই চুক্তিনামা আদালতের ডিক্রির ন্যায় ব্যবহৃত হবে। আর মধ্যস্থতা সম্ভব না হলেই কেবল কোনো পক্ষ মামলা করতে আদালতে যেতে পারবেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে সারা দেশে ৪৫ লাখ মামলা বিচারাধীন। মামলাজট চরম আকার ধারণ করেছে। বিদ্যমান মামলার সঙ্গে প্রতিনিয়ত নতুন দায়েরকৃত মামলা যুক্ত হচ্ছে। মামলার সংখ্যানুপাতে বিচারকের সংখ্যা অপ্রতুল। এ অবস্থায় যেসব বিরোধ এবং অভিযোগ আপসযোগ্য অথবা বিবদমান পক্ষগণের সমঝোতায় দ্রুত এবং সহজে নি®পত্তি করা সম্ভব, সেসব বিরোধ বা অভিযোগ চিহ্নিতক্রমে মামলা দায়েরের আগেই মধ্যস্থতার মাধ্যমে নি®পত্তি করা গেলে বিচারপ্রার্থীরা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি এ খাতে রাষ্ট্রের অর্থ ব্যয়ও হ্রাস পাবে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ